“কিরে জলিল তোর বউয়ের এখনো বাচ্চা হয়নাই?” তীর্যক সুরে ফোনের অপর প্রান্ত থেকে কথাটা বললো হাসনা খালা। জলিল কথার উত্তর না দিয়ে ফোনটা কেটে দিলো। শুধু খালা নয়, এই সমাজের বহু মানুষ তাকে প্রায়ই এই কথাটি শোনায়। এখনো বাচ্চা হয়নি। হয়ত ভবিষ্যতে হবে। নাহয় হবেনা। এ নিয়ে মানুষের এত মাথা ব্যথা কেন? এ প্রশ্নের উত্তর জানা নেই জলিলের। বিলকিস আর জলিলের বিয়ে হয়েছে ছয় বছর সাত মাস। দুজনেই বাচ্চার জন্য অনেক চেষ্টা করেছে কিন্তু ফলাফল শূণ্য। ডাক্তার, কবিরাজ কোন কিছুই বাকী নেই। জলিল আধুনিক চেতনায় বিশ্বাসী। তার অন্তরে কুসংস্কারের কোন ঠায় নেই। তবুও আশা নিয়ে কবিরাজের কাছে গেছে৷
ফুটফুটে একটি বাচ্চার জন্য কত আকাঙ্খা, কত বাসনা! অফিস থেকে ফিরে আব্বু আব্বু বলে কোলে উঠার কেউ নেই। সারা ঘর ফাঁকা পড়ে থাকে। এদিকে বিলকিস যেন দিন দিন কাঠের মত শক্ত হয়ে যাচ্ছে। কথা কম বলে, হাসে কম। মুখটা মলিন করে থাকে বেশি। তার দুই ঠোঁটের মাঝখানে এখন আর ধবধবে সাদা দাঁতের হাস্যোজ্জ্বল ঝিলিক দেখা যায় না। দুজনের হৃদয়ে পাথরচাপা কষ্টের নোনা জল অবিরাম ঢেউ খেলে যায়। মানুষের সূচালো কথার তীরে সেই ঢেউয়ের গতি থার্মোমিটারের পারদের মত আরো তীব্রভাবে বেড়ে যায়।
গত ইদের ছুটিতে বাড়িতে গিয়ে পাড়াশুদ্ধ মানুষের কথা শুনতে হয়েছে। এর জন্য বিলকিসের আর বাড়ি যেতে ইচ্ছা করেনা। জলিলের বোনের বিয়ে হয়ছে দুই বছর আগে, এক বছরের মাথায় বাচ্চাও হয়েছে। সে তার ভাবীকে কথা শুনাতে বাকী রাখেনি। বিয়ের প্রথমদিকে বাড়িতে এলে ঘুম থেকে উঠে ভাবীর মুখ দেখলে বলতো, “কার মুখ দেখে ঘুম ভাঙলো! কপালে বুঝি সন্তান নেই।” বোন সেঁজুতি ভাইকে আবার বিয়ে দেওয়ার জন্য মায়ের কানে পরামর্শ দিয়েছে। এখন বাড়িতে কলরব উঠেছে জলিলকে আবার বিয়ে দিতে হবে। এই অপয়া মেয়ের কারণে বংশের বাতি নিভে গেছে। ছেলেকে আবার বিয়ে দিলেই ঘরে সন্তান আসবে। বিলকিসের কানে কথাটি এলে সে কিঞ্চিৎ অভিমানের সুরেই বলেছে, “আমার স্বামী যদি আবার বিয়ে করতে চায়, তাতে আমার কোন আপত্তি নেই।” জলিল বিলকিসের এই কথাটি শুনে বলে, “এমন কথা কখনোই বলবা না। তুমিই আমার প্রথম, তুমিই শেষ। কত মানুষ আছে তাদের সন্তান নেই, তাদের কি দিন চলে না? আমার কিছু লাগবে না। আমি শুধু তোমাকেই চাই।” কথাটি বলে বউয়ের বুকে সেদিন মাথা রেখে মুখ চেপে কান্নায় ভেঙে পড়েছিল জলিল। সেই কান্নার শীতলতা যেন এখনো বিলকিসের বুকে লেগে আছে।
কর্পোরেট অফিসে সারাদিন কাজের চাপ সামলে সন্ধ্যায় বাসায় এসে বউয়ের ধূসর মুখটা দেখতে মোটেও ভালো লাগে না। বিলকিসের মুখে হাসি নেই, বাড়তি কোন কথা নেই। চোখের দিকে তাকালে দেখতে পাওয়া যায় সহস্র বছরের অন্ধকার। চোখটা যেন অপ্রাপ্তির গভীর কোন নলকূপ। মেয়েটা দিন দিন যম ধরা লোহার মত ক্ষয়ে যাচ্ছে। রাতে ঘুমের মাঝে চমকে উঠে। এইভাবে চললে মেয়েটা পাগল হয়ে যাবে। তার স্বাভাবিক জীবনযাপন প্রয়োজন। কি করবে জলিল! ভেবে কূল পায়না। সেদিন মা কল দিয়ে দিয়ে বললো, সেঁজুতির ননদ লামিয়া মেয়ে হিসেবে বেশ ভালো, দেখতেও সুন্দর। এবার বাড়িতে এলে যেন একটা ফয়সালা করে। জলিল বিষয়টি আগেই সন্দেহ করেছিলো। মা যতই বলুক, সে কিছুতেই বিয়ে করবে না। এই এক জীবনে যে জীবনের সাথে সে আবদ্ধ হয়েছে সেটাই তার কাছে শ্রেষ্ঠ পাওয়া।
বিলকিস ছোট কোন শিশু দেখলেই পরম মমতায় বুকে জড়িয়ে ধরে। মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। কপালে চুমু খায়। জলিল একটা অবাক করা বিষয় খেয়াল করেছে কোন শিশু কান্নারত অবস্থায় বিলকিসের কোলে এলে একদম ঠাণ্ডা হয়ে যায়। এইজন্য মাঝে মাঝে দুই তালার শেফালি আপা তার ৬ মাসের বাচ্চার কান্না থামানোর জন্য বিলকিসের কাছে নিয়ে আসে। নয়নকে কোলে নিয়ে সে যেন হাতে চাঁদ পেয়ে যায়। বাচ্চার মুখেও হাসি, তার মুখেও হাসি। দুজনেই যেন সেই মূহুর্তে চোখে মনি-মুক্তার ঝলসানি দেখতে পায়। বিলকিসের কাছে মায়ের অসীম মমতা আছে, কিন্তু নেই নাড়ি ছেড়া ধন। এই অভাবটুকু বয়ে বেড়াতেই জীবনে তার দুঃখ।
বিলকিসের মন ভালো করার জন্য জলিল বলে, চলো আজকে আমরা পুরান ঢাকা ঘুরে আসি, অনেকদিন বাইরে খেতে যাওয়া হয়না। উত্তরে বিলকিস বলে, “না আমি যাবো না, তোমার ইচ্ছে হলে তুমি যাও।” জলিল বউয়ের হাতটা চেপে ধরে “তুমি না গেলে আমি একা যাবো? কি খাবা বলো? আজ আমি তোমাকে সব খাওয়াবো। নাজিরা বাজারের হাজির বিরিয়ানি? বেচারাম দেউরীর নান্না বিরিয়ানি? বংশালের শমসের আলীর ভূনা খিচুড়ি? ঠাটারী বাজারের আমিত্তি জিলাপি? গেন্ডারিয়ায় সোনা মিয়ার দই? রায়সাহেব বাজারের বিউটি লাচ্ছি? কি খাবা একবার শুধু বলো।” বিলকিস হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বলে, “দেখো, আমার ক্ষুধা নেই। আমি কিছু খাবো না।” জলিল আজ কিছুতেই মানবে না, ” সেদিন যে তোমাকে সবুজ রঙের শাড়ী এনে দিলাম, সেটা পড়ে এসো।
পুরান ঢাকার খাবার, রিক্সায় জলিলের সাথে ঘুরা এর সবই বিলকিসের পছন্দের। নিজের মনের ইচ্ছায় থাকলেও মনের বিরুদ্ধে গিয়ে নির্দিষ্ট একটি দুঃখ বয়ে বেড়িয়ে মন খারাপ করে থাকে মেয়েটা। দুজনে একসাথে বের হয়েছে। নীলক্ষেত মোড় দিয়ে রিক্সা আজিমপুর হয়ে পুরান ঢাকায় ঢুকছে। চারিদিকে হাজার হাজার মানুষ,অসংখ্য গাড়ির হর্ণের ভিতরেও দুজনের জগতটা যেন আলাদা। হুডতোলা রিক্সায় স্বামীর প্রশস্ত কাঁধে মাথা রেখেছে বিলকিস। শীতের হালকা বাতাসে গায়ে শান্তির অনুভূতি পাওয়া যাচ্ছে। রিক্সা ভাড়া দিতে যাওয়ার সময় রিক্সাওয়ালা মামা বললেন, “মামা আমার পুলাডার মেলা অসুখ। কয়ডা ট্যাহা বাড়াইয়া দিবেন?” রিক্সাওয়ালার বলতে দেরি হলো জলিলের দিতে দেরি হলো না। একশো টাকার দুইটা নোট হাতে দিয়ে দিলো। মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো বিলকিস।সেদিন এক রিক্সাওয়ালা বিশ টাকা বেশি চেয়েছিলো বলে কত তর্ক করেছিলো জলিল। আজ সেই জলিল দুইশো টাকা দিয়ে দিলো! কোন সন্তানের অসুখের কথা সইতে পারে না জলিল।
দুই বছর পর হঠাৎ বিলকিসের মাথা ঘোরে, বমি হয়। ডাক্তারের কাছে গিয়ে জানা গেলো গর্ভবতী সে। সুখের সংবাদ। চারদিকে হৈচৈ পড়ে গেলো। অবশেষে সন্তানের মুখ দেখবে জলিল। বাচ্চা জন্ম দিতে গিয়ে বিলকিসের প্রাণ যায় যায় অবস্থা। ডাক্তার জানালেন মায়ের অবস্থা ভালো না। যেকোন সময় দূর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। খবর এলো, বিলকিস মৃত সন্তান প্রসব করেছে। অজ্ঞান থাকায় মৃত সন্তানের কথা জানেনা বিলকিস। গতরাত সাড়ে এগারোটার দিকে হুট করে প্রসব বেদনা উঠায় গ্রামের বাড়ি থেকে এখনো কেউ আসেনি। জলিল খবর টি কাউকে জানাতে চাইলো না। এত বছর পর সন্তান হলো, তবুও মৃত এ কথা জানলে বিলকিস মরেই যাবে।
হাসপাতালে একই রাতে বাবা মায়ের পরিচয়হীন এক নবজাতক শিশু পাওয়া গেছে। দায়িত্ব নিতে ইচ্ছুক এমন বাবা মাকে শিশুটি দিবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। শিশুটির চিৎকার জলিলের বুক বিদীর্ণ করে দিচ্ছিলো। কোন পাষাণ মানুষ এমন কাজ করেছে কে জানে! কেউ সন্তানের আশায় এক যুগ পার করে দেয়, আবার কেউবা গর্ভের সন্তান হাসপাতালে ফেলে দিয়ে চলে যায়! জলিল চট করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করলো আমার স্ত্রী যে মৃত সন্তান প্রসব করেছে এটা যেন কেউ না জানে। পুরো আট ঘন্টা অজ্ঞান থাকার পর জ্ঞান ফিরলো বিলকিসের। চোখ মেলে দেখে পাশে ফুটফুটে একটি শিশু। চিৎকার করে কান্না করছে। “আমার সোনা বাবা, বুকে আয়”, বলে বুকে জড়িয়ে নিতেই শিশুটির কান্না থেমে গেলো।
মায়ের এমন স্নিগ্ধ মমতার দৃশ্য দেখে দরজায় দাঁড়িয়ে চোখের জল মুছলো জলিল। সকালেই গ্রাম থেকে বাবা, মা সবাই এসে পৌছালো। “মিষ্টি আনতে যাচ্ছি”, একথা বলে জলিল রায়েরবাজার কবরস্থানের দিকে রওনা হলো। বিলকিস এর মুখে আজ বহুদিন পর হাসির উল্লাস। সে জানতেও পারলো না তার গর্ভের সন্তানকে দাফন করতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে রায়েরবাজার কবরস্থানে, আর তার বুকে অন্য কারো সন্তান।